এই শহরটিতে রয়েছে কয়েক শ খাবারের হোটেল বা রেস্তোরাঁ। তবে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে শহরের সব রেস্তোরাঁয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে সব ধরনের আমিষ বা মাংস। তাই শহরটিতে শতভাগ আমিষমুক্ত বা নিরামিষভোজী শহর বলা হয়।

পৃথিবীর সব থেকে জনবহুল দেশগুলোর একটি ভারত। দেশটিতে প্রায় ৮০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বাস। যাদের মধ্যে অন্তত ২০ ভাগই নিরামিষভোজী। ধর্মীয় দিক থেকে দেশটির অন্যতম প্রাচীন শহর উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বেনারস, যা ভারানসি নামেও পরিচিত। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান বলে খ্যাত শহরটির গোড়াপত্তন ১৮০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে। ধর্মীয় দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম পবিত্র শহরও বলা হয় বেনারসকে। এই শহরটিতে রয়েছে কয়েক শ খাবারের হোটেল বা রেস্তোরাঁ। তবে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে শহরের সব রেস্তোরাঁয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে সব ধরনের আমিষ বা মাংস। তাই শহরটিকে শতভাগ আমিষমুক্ত বা নিরামিষভোজী শহর বলা হয়। গঙ্গা নদীর পাশে অবস্থিত বেনারস শহরের বাসিন্দাদের প্রতিদিন ঘুম ভাঙে মন্দিরে বাজা ঘণ্টার শব্দে। সকাল সকাল প্রায় ১০ হাজার উপাসক গঙ্গার প্রায় ৮৮টি ঘাটে নিজেদের শুদ্ধ করতে নেমে পড়েন। তাদের মতে গঙ্গা পবিত্র নদী এবং এতে গোসল করলে সব পাপ ধুয়ে যায়। স্থানীয় লোকদের ভাষ্য, শতভাগ আমিষমুক্ত এই শহরে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় নিরামিষ খাবারের স্থান।

হিন্দু পুরাণে উল্লেখ আছে, দেবতা শিব, যাকে ধ্বংস বা বিনাশকারী বলেও মনে করা হয়; সে-ই বেনারস শহর প্রতিষ্ঠা করেন। বেনারসের মূল বাসিন্দারা মূলত শিবের অনুসারী। তাদের মতে, শিব একজন নিরামিষভোজী দেবতা। আর সে সূত্র ধরেই বেনারসে নিরামিষ খাওয়ার প্রচলন ঘটে। তারা ধীরে ধীরে এতটাই কট্টর নিরামিষাশি হয়ে ওঠেন যে, এই শহরের কোনো পরিবারে কেউ কাউকে ডিম কিনতে দেখলেও সে পরিবারের পানি পর্যন্ত ছোঁয়া অশুচি বা পাপ মনে করা হয়। তবে বেনারস ভারতের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় তীর্থস্থান হলেও প্রতিবছর এখানে লাখ লাখ পর্যটক যান। তাদের মূল উদ্দেশ্য, শহরের শিল্প, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও ইতিহাস জানা। পাশাপাশি নিরামিষভোজীদের জন্য খাবার তৈরির কারণে পৃথিবীর বিখ্যাত সব রন্ধনশিল্পীদের আগ্রহের জায়গাও বেনারস। তারা এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোকে তাদের মতো করে বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় করে তোলেন।

২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত টানা মিশেলিন স্টার (রেস্টুরেন্টগুলোকে দেয়া পদক) পাওয়া শেফ ভিকাস খান্না ২০২০ সালে লোনলি প্ল্যানেট ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বেনারসের ছোট এক মন্দিরে একবার ‘ভ্রাত কে কুট্টু’ নামে এক ধরনের প্রসাদ খাই, যা মূলত ময়দা এবং অন্য কিছু উপাদান দিয়ে বানানো প্যানকেক-জাতীয় খাবার। আমি আমার ম্যানহাটনের রেস্টুরেন্ট ‘জুনুনে’ এটি বানানোর চেষ্টা করি। এর স্বাদ আসলে স্বর্গীয়।” এ ছাড়া দুইবার মিশেলিন স্টার পাওয়া আরেক শেফ অতুল কচ্ছার লন্ডনে বেনারস নামে একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন। যেখানে কেবল বেনারসের নিরামিষ খাবার পাওয়া যায়। এমনকি ভারতের তারকা শেফ সঞ্জিব কাপুর বেনারসের খাবার নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। লেখাগুলোয় নিরামিষের বিভিন্ন ধরনের কথা উল্লেখ করেন তিনি। আসলে বেনারসের এসব নিরামিষ খাবারের মধ্যে আয়ুর্বেদিক গুণ থাকায় এবং বিশেষ রন্ধনশৈলীর জন্য এটা সনাতন ধর্মের খাদ্যাভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এসব খাবারে কোনোভাবেই পেঁয়াজ-রসুন ব্যবহার করা হয় না। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, এই উপাদানগুলোতে রয়েছে রাগ, উগ্রতা ও উদ্বেগ; যা একজন মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার পথে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের পুরোহিত অভিশেক শুকলা বলেন, ‘বেনারসের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই শিবমন্দির পাওয়া যায়। সেখানকার মানুষ মাংস খাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাংস খেলে স্বর্গলাভ করা যায় না। কেননা মাংস খাওয়ার জন্য যেসব প্রাণীকে হত্যা করা হয় ,তাদের অভিশাপে মানুষের আত্মাকে পরকালে সাজা ভোগ করতে হয়। যে শহরের রেস্তোরাঁয় মাংস নিষিদ্ধ ভারতের বেনারসে গঙ্গা নদীতে নৌকার এক তীর্থযাত্রী। ছবি: বিবিসি এ ছাড়া মাছ-মাংস আর পেঁয়াজ-রসুনের মতো খাবারগুলো মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ায়। এমনকি এসব খেলে মানুষের বিচারক্ষমতা পর্যন্ত লোপ পায়। তখন আর তাদের স্বাভাবিক বোধশক্তি থাকে না।’ তবে কয়েক বছর আগেও আমিষভোজী পর্যটক আর তীর্থযাত্রীদের জন্য বেনারসের রেস্তোরাঁগুলোতে মাছ-মাংসের ব্যবস্থা থাকত। নিরামিষ শুধু বাসা-বাড়ি আর নিরামিষ হোটেলগুলোতে পাওয়া যেত। সেটিও বন্ধ করে দেয়া হয় ২০১৯ সাল থেকে। পরে বেনারস শতভাগ ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষী শহর হয়ে ওঠে। অবশ্য শহরটিতে আরেকটি প্রথা ধরে রেখেছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। সেটি হলো, খাবার পরে পান খাওয়া। বেনারসের পানও খুব বিখ্যাত ও শহরের ঐতিহ্য। করোনাভাইরাস মহামারিতে বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে শহরটি।